।। অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
কোয়ারেন্টিনা
-অমিত কুমার জানা
মে মাসের মাঝামাঝি পশ্চিমবঙ্গ সহ সারা ভারতবর্ষে করোনা সংক্রমণ আবার নতুন রূপে দেখা দিল। দেশব্যাপী সংক্রমণের হার এবং মৃত্যুর হার সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেল। তিন বছর পূর্বে করোণা সংক্রমণের কারণে দেশে লকডাউন এর জন্য অনেক আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। দরিদ্র এবং মধ্যবিত্তরা চরম সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল।
মেদিনীপুর জেলার কুমারপাড়া একটা ছোট্ট গ্ৰাম। সেই গ্ৰামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে মানস গতবছর মাধ্যমিক পাশ করেছে। তার বাবা বিধানবাবু কথা দিয়েছিলেন যে মানস মাধ্যমিকে আশি শতাংশের উপরে মার্কস্ পেলে তাকে একটা মোবাইল গিফ্ট করবেন। কিন্তু মানসের ভাগ্যে মোবাইল জুটলো না। কারণ গতবারে মাধ্যমিক পরীক্ষাই হয়নি করোনা সংক্রমনের কারণে। মধ্যশিক্ষা পর্ষদ সব পরীক্ষার্থীকে গড় মার্কস দিয়ে পাশ করিয়ে দিয়েছিল। বাধানবা সেই অজুহাত দেখিয়ে ছেলেকে আর মোবাইল কিনে দেন নি।
সেই থেকে মানসের তার বাবা মায়ের উপর খানিক অভিমান জমে আছে।
বিধানবাবু একসময় বিডিও অফিসে কেরানীর চাকরি করতেন। কিন্তু প্রতিনিয়ত মদ্যপান করে অফিস আসতেন। একাধিকবার শোকজ করেও কোন লাভ হয়নি। শেষমেষ এই বদঅভ্যাসের শাস্তি স্বরূপ তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। এরপরেও বিধানবাবু মদ্যপান থেকে একদিনও বিরত থাকেন না। শুধু তাই নয় ,তাঁর পত্নী কাকলীদেবী টেলারিংয়ের কাজ করে যা উপার্জন করেন তাতেও তিনি জবরদস্তি ভাগ বসিয়ে সেই টাকায় মদ্যপান করেন।
মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে সারা পশ্চিমবঙ্গে করোনার প্রকোপ বাড়তে থাকল হু হু করে। মেদিনীপুর জেলার কুমার পাড়া গ্রামও করোনার হাত থেকে রেহাই পেল না। শহরের মত সংক্রমণের হার এত বেশি না হলেও গ্রামেও বেশকিছু মানুষ আক্রান্ত হতে লাগলো।
গত তিন-চার দিন ধরে মানসের তিন বছরের ছোট্ট বোন অনুজা জ্বরে ভুগছিল। তিন বৎসর পূর্বে ভারতে যখন প্রথম করোনার সংক্রমণ হতে শুরু করেছিল সেই সময় ওর জন্ম হয়। সেই সময় থেকেই এখানকার মানুষ কোয়ারেন্টাইন শব্দটার সঙ্গে পরিচিতি লাভ করে ।
তাই ওর মা ওকে কোয়ারেন্টাইন বলে ডাকে।
বিধানবাবু স্থির করলেন যে অনুজার কলকাতায় কোভিড টেস্ট করাবেন এবং প্রয়োজন হলে ওখানেই ভর্তি করাবেন। এতে অনুজার মা ভীষণ আপত্তি করলেন এবং বললেন যে মেদিনীপুরে তো এখন কোভিড টেস্ট হচ্ছে এবং কোভিড পজিটিভ রোগীদের ভর্তিও নিচ্ছে। বিধানবাবু বললেন, ” মোটেই না,এখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থা আমার জানা অছে! বহু রোগী ভুল চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। আমি মেয়েকে কলকাতা নিয়ে যাবোই।”
বিধানবাবুর নাছোড়বান্দা জেদের কাছে কাকলীদেবী হার মানলেন।
লকডাউনের জন্য প্রায় সব লোকাল এবং এক্সপ্রেস ট্রেন বন্ধ থাকায় একটা মারুতি ভ্যান ভাড়া করে অনুজাকে কলকাতা নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। মারুতিতে সপরিবারে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। বিধানবাবু বললেন, ” চিন্তার কোন কারণ নেই,ওখানে আমার এক বন্ধু থাকে,কোন অসুবিধায় পড়লে ও হেল্প করবে।”
চৌরঙ্গীর মোড়ে রেড সিগন্যাল থাকায় মারুতি থামলো। অনুজা তার বাবার মোবাইলে গেম খেলছিল। মারুতির ডানদিক ঘেঁষে একটা এম্বুলেন্স এসে থামলো। এদের সবার দৃষ্টি পড়লো এম্বুলেন্স-এর উপর। অনুজা গেম খেলা বন্ধ করে মারুতির বাইরের দিকে নজর দিল। নজর দিতেই তার কানে একটা আওয়াজ ভেসে এলো “বাঁচাও বাঁচাও”। বিধানবাবু বললেন যে কোন রোগী রোগের যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছে হয়তো। কিন্তু ছোট্ট অনুজার মনে সন্দেহ ঘনীভূত হলো, “রোগী বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করে না,বরং কেউ কিডনাপ হলে এমন চিৎকার করে।”
ছোট অনুজার শ্রবণশক্তি এবং বুদ্ধিমত্তা। অন্যদের তুলনায় বেশি। সে তখনই তার বাবাকে বলল যে তাকে এখনই গাড়ি থেকে একটু নামতে হবে এবং সে তখনই মারুতি থেকে নেমে পড়লো। তারপর এম্বুলেন্সের নাম্বার মনে মনে নোট করে নিল। তারপর এক মুহূর্ত দেরি না করে পুলিশের টোল ফ্রি নাম্বারে ফোন করে ব্যাপারটা জানিয়ে দিল। এরপর অনুজা বাবাকে বললো একটু অপেক্ষা করতে।
মেদিনীপুর কোতয়ালী থানা থেকে চৌরঙ্গীর দূরত্ব মাত্র আট কিলোমিটার। দশ মিনিটের মধ্যে সিনিয়ার ইন্সপেক্টর সহ এক ভ্যান পুলিশ হাজির হলো চৌরঙ্গীর মোড়ে। উনারা অনুজার বাবার কাছ থেকে জানতে পারলেন যে ঐ এম্বুলেন্সটি এন.এইচ.সিক্সের দিকে চলে গেছে। ইন্সপেক্টর তখনই নিকটবর্তী ট্রাফিক এবং টোল প্লাজায় ফোন করে জানিয়ে দিলেন ঐ এম্বুলেন্সের নাম্বার এবং এও বললেন যে এম্বুলেন্সে কে কে আছে চেক করে ছাড়তে। এরপর তিনি ছোট্ট অনুজার নাম জিজ্ঞেস করলেন। কাকলীদেবী বললেন ,”আমার মেয়েকে আমি ‘কোয়ারেন্টিনা’ বলে ডাকি।” “বাহ্,বেশ আনকমন নাম “-বললেন ইন্সপেক্টর।
এরপর ইন্সপেক্টর তাঁর নিজের মোবাইল নাম্বার কাকলীদেবীকে দিয়ে বললেন, “আমার নাম্বার নোট করে রাখুন,কোন অসুবিধায় পড়লে জানাবেন।”। যদিও বিধানবাবু বললেন, “না না, কি আর অসুবিধা হবে? ধন্যবাদ।”
এর পনেরো মিনিট পর পঁচিশ কিলোমিটার দূরে একটা টোল প্লাজায় পুলিশ ঐ এম্বুলেন্স থামিয়ে তল্লাশি করে জানতে পারেন সত্যি সত্যিই ওতে যে মেয়েটা চিৎকার করছিল সে রোগী নয়। তাকে কিডনাপড্ করা হয়েছে। এম্বুলেন্সের চালক সহ কিডনাপ কাণ্ডে জড়িত আরও দুজনকে পুলিশ গ্ৰেপ্তার করেন। মেয়েটার বয়স আঠারোর উপরে,ওকে চন্দ্রকোণা রোড থেকে কিডনাপ করে কলকাতা নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল কোন নিষিদ্ধ পল্লীতে বিক্রি করে দেওয়ার জন্য। যাইহোক ওকে উদ্ধার করে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হয়।
এর দু দিন পর। ইন্সপেক্টর সাহেব গত দুদিন ধরে ভীষণ উতলা হচ্ছিলেন এই ভেবে যে যার জন্য মেয়েটাকে উদ্ধার করে বাড়ি পৌঁছে দিতে পারলাম সেই কোয়ারেন্টিনাকে একটা ‘থ্যাংকস’ জানাবার সুযোগ হলো না। কেননা,উনার কাছে কোয়ারেন্টিনার বাড়ির মোবাইল নাম্বারও ছিল না।
হঠাৎ সকাল সাতটা নাগাদ ইন্সপেক্টর সাহেবের মোবাইলটা বেজে উঠলো। ” ইন্সপেক্টর সাহেব আমি কোয়ারেন্টিনার মা বলছি। কলকাতার একটা হাসপাতালে করোনা সন্দেহে আমার মেয়েকে ভর্তি করেছিলাম দু দিন আগে। হাসপাতাল কতৃপক্ষ কিছুতেই মেয়ের সাথে আমাকে দেখা করতে দিচ্ছেন না। খুব ভয় লাগছে।”
ইন্সপেক্টর বললেন ,” বেশি চিন্তিত হবেন না, আমি তিন চার ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছি। আর হ্যাঁ, এটা আপনার মোবাইল নাম্বার তো?”
কাকলীদেবী বললেন, ” না, ওর বাবা মোবাইলটা আমাকে একবারও দিচ্ছে না কল করার জন্য। শুধু একটাই কথা বলছে যে অযথা ঝামেলায় জড়িয়ে লাভ নেই,বরং সমস্যা আছে। আমি একটা অপরিচিত লোকের মোবাইল থেকে আপনাকে ফোন করছি।”
ইন্সপেক্টর এটা শুনে বেশ অবাক হলেন। সকাল এগারোটার সময় ইন্সপেক্টর সাহেব কলকাতার উক্ত হাসপাতালে পৌঁছে গেলেন এবং কাকালীদেবীর সাথে দেখা করলেন। দেখলেন কাকালীদেবীর দু চোখ বেয়ে অঝোর ধারা ঝরে পড়ছে। তিনি কাঁদতে কাঁদতে ইন্সপেক্টরকে বললেন, “একটু আগে হাসপাতাল থেকে জানানো হলো যে আমার মেয়ে করোনায় মারা গেছে। এটা হতে পারে না। তাছাড়া ও যদি সত্যিকারের করোনা পজিটিভ ছিল তাহলে হাসপাতাল কতৃপক্ষ একবারও আমাদের জানায় নি কেন? “
ইন্সপেক্টর জিজ্ঞেস করলেন যে কোয়ারেন্টিনা কোন বিল্ডিংয়ে ভর্তি ছিল। কাকলীদেবী আঙুল দেখিয়ে বললেন,” ঐ যে দোতলায় বিধানব্লকে।”
ইন্সপেক্টর কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ঐ বিধানব্লকের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। দোতলার একটা জানালাগুলো খোলা ছিল। হঠাৎ জানালা দিয়ে একটা ছোট্ট হাত নাড়া দিয়ে উঠলো এবং উচ্চস্বরে বললো, “পুলিশ আঙ্কেল,আমি কোয়ারেন্টিনা, আমাকে বাঁচাও।”
ইন্সপেক্টরের কানে কোয়ারেন্টিনার আর্ত চিৎকার পৌঁছে গেল। তিনি আর দেরি না করে দ্রুত বিধানব্লকে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু গেটকীপার বাধা দিলেন। ইন্সপেক্টর আই.কার্ড দেখিয়ে ধমক দিয়ে সোজা উপরে উঠে গেলেন। উপরে উঠে দেখলেন বিধানব্লকের এন্ট্রান্সের সামনে কয়েকজন মস্তান গোছের লোক দাঁড়িয়ে আছে। ওদের মূলপাণ্ডা উনাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কি চাই আপনার?”
—-“এখানে অনুজা নামে একটা বাচ্চা মেয়ে ভর্তি ছিল। ওকে নিতে এসেছি।”
—–“ও করোনায় মারা গেছে। এই হাসপাতালের রুল অনুযায়ী করোনা পেসেন্টের লাশ ফেরৎ দেওয়া হয় না।”
——(মূলপাণ্ডার গালে সজোরে এক চড় মেরে) “তাহলে আমি কি অনুজার ভূতের সাথে কথা বললাম?” ও আমাকে নিজে উপর থেকে ওর নাম জানিয়েছে। তাই ওকে নিতে এসেছি।”
এরপর ইন্সপেক্টর সজোরে বিধানব্লকের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করেন এবং কোয়ারেন্টিনা (অনুজা)-কে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। নীচে এসে তিনি বিধানবাবুর চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করেন, “কি বিধানবাবু, আপনি নাকি আপনার মোবাইল পর্যন্ত আপনার পত্নীকে কল করার জন্য ব্যবহার করতে দেননি? আপনি সত্যিই আপনার মেয়ের মঙ্গল চান? আচ্ছা শুনেছিলাম, এখানে আপনার কে বন্ধু আছে? উনার নাম ,ঠিকানা বলবেন?”
বিধানবাবু নতমস্তকে নিরুত্তর থাকলেন। ইন্সপেক্টরের ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধা হলো না। তিনি কলকাতা কলকাতার বিধাননগর থানায় উক্ত হাসপাতালের নামে অভিযোগ দায়ের করলেন। কলকাতা পুলিশ দলবল নিয়ে এলেন ঐ হাসপাতালে। তাঁরা জানতে পারলেন যে ঐ হাসপাতালে করোনা চিকিৎসার নামে মানুষের মূল্যবান অঙ্গ বিক্রির ব্যবসা চলছে। অপারেশন করে কিডনি, হার্টের মতো অমূল্য অঙ্গ বের করে রোগীকে করোনায় মৃত বলে ঘোষনা করে দেওয়া হচ্ছে এবং করোনার সংক্রমনের ভয় দেখিয়ে রোগীর আত্মীয়দের সাথে কোনরকম সম্পর্ক বা যোগাযোগ করতে দেওয়া হচ্ছে না । এরপর ঐ হাসপাতাল সিজ্ড করে দেওয়া হয় এবং আদালতের রায়ে চিকিৎসাকে হাতিয়ার করে এই ঘৃণ্য কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত ডাক্তার,নার্স এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কঠিন শাস্তি ও জরিমানার ব্যবস্থা করা হয়।
কোয়ারেন্টিনা সপরিবারে বাড়িতেই আছে। সুস্থ আছে। ওর করোনাই হয়নি। তবুও জোরজবরদস্তি ওর বাবা বিধানবাবু কলকাতার ঐ হাসপাতালে মেয়েকে ভর্তি করিয়েছিলেন। কারণ বিধানবাবু জানতেন ঐ হাসপাতালে শিশু থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক রোগীদের মূল্যবান অঙ্গ বিক্রির কারবার চলে। এইজন্য বিধানবাবুর সঙ্গে আগে থেকেই হাসপাতালের এক দালালের সাথে মোটা টাকার চুক্তি হয়। ইন্সপেক্টর সাহেব এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না যে বিধানবাবু টাকার জন্য নিজের তিন বছরের মেয়েকে—-,ছি ছি। যদিও তিনি ব্যাপারটা গোপন রেখে নিজের পরিপারের কাছে বিধানবাবুকে ছোট হতে দেননি। তবে কোয়ারেন্টিনার ইন্সপেক্টর সাহেবের একটা দীর্ঘমেয়াদি সুন্দর সম্পর্ক তৈরী হয়ে গেল। এখনও পরস্পরের সাথে ফোনালাপ হয়। আর বিধানবাবু এখন আগের চেয়ে অনেক ভদ্র হয়েছেন, মদ্যপান ও কমিয়ে দিয়েছেন।